আজ রক্তঝরা ১৫ আগস্ট -
 |
http://nirrjon.blogspot.com |
কেঁদেছিল আকাশ, ফুঁপিয়ে ছিল বাতাস। বৃষ্টিতে নয়, ঝড়ে নয়- এ অনুভূতি ছিল শোকের। পিতা হারানোর শোক। প্রকৃতি কেঁদেছিল; কারণ মানুষ কাঁদতে পারেনি। ঘাতকের উদ্ধত সঙ্গিন তাদের কাঁদতে দেয়নি। কিন্তু ভয়ার্ত বাংলার প্রতিটি ঘর থেকে এসেছিল চাপা দীর্ঘশ্বাস। কী নিষ্ঠুর, কী ভয়াল, কী ভয়ঙ্কর- সেই রাত।
ভুলতে চায়নি, ভুলতে পারবে না। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে অশ্রুভেজা, কলঙ্কময় রাতের কথা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতের কথা। যে রাতে স্ত্রী-সন্তানসহ সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বছর ঘুরে রক্তের কালিতে লেখা সে দিন-রাত আবার ফিরে এসেছে।
কবি শামসুর রাহমানের সঙ্গে উচ্চারিত করি_ 'ধন্য সেই পুরুষ, যার নামের উপর রৌদ্র ঝরে/চিরকাল গান হয়ে/নেমে আসে শ্রাবণের বৃষ্টিধারা/যার নামের উপর কখনো ধুলো জমতে দেয় না হাওয়া/ধন্য সেই পুরুষ যার নামের উপর ঝরে/মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ধ্বনি।'
১৯৭৫ সালের এদিন স্ত্রী বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, পুত্র- শেখ কামাল, শেখ জামাল ও ১০ বছরের শিশুপুত্র শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল এবং এক সহোদরসহ আত্মীয়-পরিজন নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হন জাতির জনক।
১৫ আগস্টের নির্মম সেই হত্যাযজ্ঞে আরো নিহত হন বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছেলে আরিফ সেরনিয়াবাত, মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, শিশু পৌত্র সুকান্ত বাবু, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, নিকটাত্মীয় শহীদ সেরনিয়াবাত, আবদুল নঈম খান রিন্টু এবং বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঁচাতে ছুটে আসা রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদসহ কয়েকজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও কর্মচারী।
১৫ আগস্টকে ফিরে দেখতে চাইলেই মানসচক্ষে ভেসে উঠে বাঙালির স্বাধীনতার অন্যতম তীর্থস্থান ধানমন্ডির- ৩২ নাম্বার সড়কের ৬৭৭ নাম্বার বাড়িটি। যেখানে সে রাতে আগামী দিনের কর্মসূচি দেখে ক্লান্ত বঙ্গবন্ধু ঘুমিয়ে ছিলেন। হঠাৎই একদল বিপথগামী তরুণ সেনা ট্যাঙ্ক দিয়ে ঘিরে ফেলে ভবনটি। একে একে নিহত হন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য নিবেদিত প্রাণ এক পরিবারের সদস্যরা। সুবহে সাদেকের সময় পবিত্র আজানের ধ্বনিকে বিদীর্ণ করে ঘাতকদের মেশিনগানের ঝাঁক ঝাঁক গুলি। বাড়ির সিঁড়িতে অযত্ন অবহেলায় পড়ে ছিল জাতির জনকের রক্তাক্ত মৃতদেহ। আর অন্যত্র ছড়ানো-ছিটানো ছিল বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামাল, তার স্ত্রী সুলতানা কামাল, অপর পুত্র শেখ জামাল ও তার স্ত্রী রোজি জামাল এবং কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলসহ অনেকের লাশ।
ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে দেখা যায়, নারকীয় এই সেনা অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেন আওয়ামী লীগের বিক্ষুব্দ কিছু সদস্য এবং বিপথগামী কিছু সামরিক কর্মকর্তা। এদের মধ্যে ছিলেন শেখ মুজিবের প্রাক্তন সহকর্মী খন্দকার মোশতাক আহমেদ, যিনি তার স্থলাভিষিক্ত হন। সংবাদ মাধ্যমে এ হত্যাকান্ডের ইন্ধনদাতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি সিআইএ-কে দায়ী করা হয়। ১৬ আগস্ট তার মরদেহ তার জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ায় হেলিকপ্টারে করে নিয়ে যাওয়া হয়। মাত্র পনের মিনিটে সামরিক তত্ত্বাবধানে মাটির নিচে শুইয়ে দেয়া হয় হিমালয়সম সাহসী এই মানুষটিকে, অন্যদের ঢাকার বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।
দেশদ্রোহী খুনিরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে তার নাম চিরতরে মুছে ফেলতে চেয়েছিল। আর সেজন্যই ৪২ বছরের বেশির ভাগ সময়ই পনের আগস্ট দিনটি ছিল রাষ্ট্রীয়ভাবে চরম অবহেলিত।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ১৯৯৬ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ১৫ আগস্টকে রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় এসে সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেয়। এ ছাড়াও বিধি সংশোধন করে সরকারিভাবে নির্ধারিত দিন ছাড়া জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণার মাধ্যমে দিনটি সরকারি ছুটি হিসেবে পুনর্বহাল করে।
বঙ্গবন্ধু মৃত্যুঞ্জয়ী এমন এক বীরের নাম, যিনি জীবনের শেষক্ষণেও ছিলেন দৃঢ়চেতা। তার মৃত্যুর মধ্যদিয়ে মৃত্যু ঘটে একজন মহান জাতীয়তাবাদী নেতার।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন